Magic Lanthon

               

তৈয়ব তরুণ

প্রকাশিত ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

রবি’র ওসিএস নেটওয়ার্কের বিজ্ঞাপন

বিষয়বস্তু : নিবিড় বন্ধন, মূল প্রতিপাদ্য ব্যবসা

তৈয়ব তরুণ


সেই প্রথম থেকেই তো দিয়ে আসছে! প্রকৃতি মানুষকে আর কতো দেবে? তাই দেওয়ার পরিমাণ এখন আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। কিন্তু চাই এর পরিমাণ তো আর কমেনি! এ-কথা যে-কেবল আমিই বুঝি, বিষয়টি মোটেও তা-নয়। অনেকেই বোঝেন। অনেককেই বুঝতে হয়; বিভিন্ন প্রয়োজনে। যেমন ধরুন, যাদের অঢেল অর্থের প্রয়োজন তারা কিন্তু অনেক আগেই বুঝে ফেলেছেন; প্রকৃতির কাছ থেকে আর আগের মতো করে প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। তারও তো সাধ্যের একটা সীমা আছে! তাহলে উপায়? উপায় তো একটা বের করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত বের হলো-চাহিদার সমস্ত কর্মভার যে-করেই হোক মানুষের মাথায়ই চড়াতে হবে। তার মানে অঢেল মানুষ দরকার। মানুষ বলতে চোখ-কান খোলা রাখা মানুষ হলে হবে না। দরকার মনমরা-মানুষ, দরকার জড়-মানুষ। যার ওপর প্রয়োজনের সব কর্মভার চাপানো যায় খুব সহজেই।

সত্যি বলতে কী, আমি বিশ্বাস করি-আমরা দিনদিন এ-রকম মানুষই হতে চলেছি, অনেকখানি হয়েও গেছি। যাদের ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তারা এখন এই জড়-মানুষ হিসেবেই আমাদের ব্যবহার করতে চাইছে; করছেও। পরোক্ষভাবে বলতে গেলে, আমরা এখন এক ধরনের প্রজা। আর আধুনিক সমাজ চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কীভাবে এ-রকম আরও নতুন-নতুন প্রজা বানানো যায়। কারণ, যারা এ-রকম মানুষ হয়ে গেছে, তারা তো হয়েই গেছে! দেখার বিষয় হলো-কেউ বাকি আছে কি না। এই বাকিদের শাসন-শোষণের আওতায় আনতে নানান চেষ্টা চালান রাজারা।চেষ্টার অংশ হিসেবে যে-যে পন্থা তারা আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন তার মধ্যে বিজ্ঞাপন শীর্ষ স্থানীয় একটি। যে-পন্থায় প্রজা বানানোর প্রস্তাব দেওয়া যায় রাজা হওয়ার কথা বলে।

এতোক্ষণ এই ভেড়া-প্যাচাল এ-জন্য পাড়লাম যে, আদিবাসীদের নিয়ে নির্মিত বেসরকারি টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি রবির একটি বিজ্ঞাপন দেখে আমার এমনটিই মনে হয়েছে। যেখানে আদিবাসীরা আমার বিশ্বাস, বুঝতেও পারবে না তাদেরকে আসলে নতুন প্রজা হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, বিজ্ঞাপনটিতে বাচনের সঙ্গে বাস্তবতার রয়েছে বেশকিছু গরমিল। তাই বিজ্ঞাপন নিয়ে ম্যাজিক লণ্ঠন-এর ধারাবাহিক আয়োজনে এবার আমার চেষ্টা থাকবে এই গরমিল নিয়ে কিছু বলার। এ-জন্য প্রথমেই আমি বিজ্ঞাপনের দৃশ্যায়নটা একটু তুলে ধরবো।

 

২.

বিজ্ঞাপনটির দৃশ্যায়ন এরকম-চারদিকে ঘন অরণ্য আর লতা-গুল্মে বেষ্টিত সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের ছোট ছোট কুঁড়ে ঘর। আদিবাসীদের গান ভেসে আসছে বাতাসে। এরপর দেখা গেলো, নানান সাজে সজ্জিত একটি আদিবাসী বাড়ি। দেখে বোঝা যায়, বাড়িটিতে কোনো একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে। পরে বোঝা যায়, এটি আদিবাসী এক মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান। কয়েক নারী রান্নার কাজে ব্যস্ত। এদের মধ্যে আলাদাভাবে চোখে পড়ে বাঙালি একটি ছেলে। পাশের একটি ঘর থেকেই আবার সেই ছেলের বোন ডাকে-ভাইয়া মার ফোন। ফোন রিসিভ করে ছেলেটি বলে-হ্যাঁ মা! বিয়ের অনুষ্ঠান তো কালকে, সোল (বাঙালি ছেলেটির বন্ধু), ও তো খুব খুশি। এ-সময় ঘরের ভিতর থেকে সেই মেয়েটি আবার ডাকে, সোল ভাই, একটু আসেন তো। সোল গিয়ে প্রশ্ন করে, কী সমস্যা? পাশ থেকে আদিবাসী এক মেয়ে জানায়, বিয়ের পোশাকটি কনের পছন্দ হয়নি। আরেকজন আবার বলে, লাল হলে ভালো হতো।

ততোক্ষণে ঘরে ঢুকে বাঙালি ছেলেটি বলে, সোল, চল। এরপর তারা দুজনে বেরিয়ে যায় পোশাকের খোঁজে। এই ফাঁকে বলে রাখা দরকার, বিয়েটি সোলের বোনের। বিয়ে উপলক্ষেই মূলত তার এই বাঙালি বন্ধু ও তার বোনের এখানে আসা। তারা দুজনে সেখানকার এক কাপড়ের দোকানে যায়। গিয়ে লাল রঙের মধ্যেই পছন্দসই একটি পোশাক নিয়ে আসে। পরের দৃশ্যেই বাঙালি ছেলেটি ফোনে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, কয়েকটি অপশন পাঠা। তারপর আদিবাসী কয়েকজনকে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে কয়েকটি ডিজাইন দেখিয়ে বলে, লালের উপর দিয়েই আমরা ডিজাইনটা করবো।

তারপর দেখা যায়, বাঙালি মেয়েটিকে ঘিরে আদিবাসী নারীরা আড্ডায় মেতে উঠেছে। আদিবাসী ও বাঙালি ছেলে লাল কাপড় নিয়ে ডিজাইন করতে দিচ্ছে এক আদিবাসী মেয়ের কাছে। সে কাপড়ে ডিজাইন করছে। পরের দৃশ্যে আদিবাসী মেয়েদের সঙ্গে বাঙালি মেয়েটি নৃত্য করছে।

এরপর দেখা যায়, বাঙালি মেয়েটির সঙ্গে আদিবাসী মেয়েটি (যার বিয়ে, নাম মিসুই) বাড়ির আঙিনায় একটি মাচানে বসে গল্প করছে। আদিবাসী মেয়েটি বলছে, এই জায়গাটা আমার খুব চেনা, আমার খুব মনে পড়বে। এসময় সোল পিছন থেকে মিসুই বলে ডাক দেয়। পিছন ফিরে সে সোলের কাছে হাতেকাজ করা সেই লাল পোশাকটি দেখতে পায়। লালের উপর ডিজাইন করা পোশাকটি দেখে মিসুই আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে, আমার জন্য!

পরবর্তী দৃশ্যেই দেখা যায়, মিসুই সেই লাল জামাটি পরে বিয়ের সাজে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে বাড়ির আঙিনা থেকে বের হচ্ছে। এ-সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসে-এমনই এক নিবিড় বন্ধনে সারা দেশকে বাঁধতে একমাত্র রবি-ই নিয়ে এলো বাধাহীন ও আরও শক্তিশালী ওসিএস নেটওয়ার্ক। জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে। রবি...।

 

৩.

ইতিহাসের পাতা খুঁজলে আদিবাসীদের সঙ্গে বাঙালিদের সম্পর্কের কয়েকটি চিত্র পরিষ্কার পাওয়া যাবে। তবে এগুলোর সবকিছুকে যে কেউ চাইলে দুটি ভাগে আলোচনা করতে পারেন। এর এক ভাগের নাম দিতে পারেন দ্বন্দ্ব-সংঘাত। আর অন্যটি সমঝোতার চেষ্টা। প্রশ্ন আসতে পারে সমঝোতা না হয়ে সমঝোতার চেষ্টা কেনো বললাম। বললাম এ-কারণে যে, এখন পর্যন্ত ওইটুকুই হয়েছে; অন্যকিছু হয়নি। হলে, রামুতে যা হলো-তা হতো না। এরপর শান্তিচুক্তির যুক্তি টেনে আরেকটি বিরোধিতা এখানে দাঁড় করানো যেতে পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি তা বিশ্বাস করি না। সত্যিকারার্থে শান্তিচুক্তি যে-অনুমেয় পরিস্থিতি ধারণ করে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে এ-দেশে কখনও সম্ভব হয়নি।

যাই হোক এগুলো আপেক্ষিক ব্যাপার। একেক জন একেক রকম করে ভাবতে পারেন; এবং ভাবার স্বাধীনতাও আছে। কিন্তু বাঙালি-আদিবাসীর এ-যাবৎ যতোকিছু হয়েছে তার মধ্যে একটি বিষয় স্পষ্ট। সেটি হলো, দুটি জনগোষ্ঠী সবসময় নিজেদের মতো করে ভাবতে চেয়েছে, কিছু করতে চেয়েছে। পরোক্ষভাবে বলা যায়, নিজেদের ক্ষমতাসীন দেখতে চেয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রবির ডায়লগ একটু আলাদা। নিবিড় বন্ধন; সন্দেহ হয়। কারণ, যে যা না, সে যদি নিজেকে তাই দাবি করে তবে তো সন্দেহ হবেই। আমি বলতে চাইছি রবি তো আর মানবাধিকার বিষয়ক কোনো সংগঠন না? আর আজকাল মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন নিয়েই কতো প্রশ্ন! সেখানে রবি তো টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি! তাই আমার মনে হয় নিবিড় বন্ধন নয়, প্রধান লক্ষ্য আদিবাসীদের বশে রাখা কিংবা বশে আনা। এবার আমার ধারণা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করবো।  

মিশেল ফুকোর বক্তব্য দিয়ে শুরু করি। তার মতে, আধুনিক সমাজে ক্ষমতা প্রয়োগ হয় বিশেষ সময়ে, বিশেষ জায়গায়, বিশেষ ব্যক্তির দ্বারা এবং বিশেষ ব্যক্তির ওপর। এ-ক্ষমতা প্রয়োগ বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দৃশ্যত বা অদৃশ্যত উভয়ভাবেই হতে পারে। হতে পারে নিজের মত গ্রহণের একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে। অনুরূপ রবি টেলিকমও চাইছে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করতে। যে-পরিস্থিতিতে আদিবাসীদের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করা যায় কিংবা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা নিবিড় বন্ধনের নামে কেনো? এর উত্তরে আমি তিনটি বিষয় পাই।

প্রথমত, আদিবাসী এলাকা ব্যবসার ক্ষেত্রে নতুন একটি সুযোগ। এখানে নিরীহ মানুষের মধ্যে বাজার সৃষ্টি করতে হলে নিরীহ সেজেই যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, রবি নেটওয়ার্ক এতোদিন সমতল ভূমিতে অর্থাৎ বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। সে-কারণে আদিবাসীদের জানানো যে, বাঙালিদের সঙ্গে থাকলেও মনোভাব-দৃষ্টিভঙ্গি তাদের মতো নয়। আর শেষতক, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায় বলি-প্রযুক্তির বিকাশ, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাস, শ্রমের ওপর পুঁজির নিয়ন্ত্রণের নতুন পন্থা উদ্ভাবন, অর্থলগ্নি ব্যবসার ব্যাপক প্রসার, ইত্যাদি নানা কারণে পুঁজি এখন অনেক নমনীয়। আর পুঁজি তার নমনীয়তার গুণেই এমন পরিবেশ তৈরি করছে। যে-পরিবেশে পুঁজি কোনো জোরাজুরি করে না। সম্পর্ক আপোসে আপনা-আপনি তৈরি হয়ে যায় এবং নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যে সফলতার সঙ্গে পৌঁছায়। আর বাধা পেলে নীরবে আসে চলে। এমন পরিবেশে ব্যক্তি সচেতনভাবে নিজের ভালো-মন্দ বিচার করেই সিদ্ধান্ত নেন-কোনটি করবেন আর কোনটি করবেন না। আর ব্যক্তির এমন মানসিকতার ভিতরে গিয়ে পৌঁছানোর নামই ফুকো দিয়েছেন অনুশাসন। রবি তার নেটওয়ার্ক বিস্তারের ক্ষেত্রে এই অনুশাসন প্রক্রিয়াই প্রয়োগ করেছে। যে-প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপের নামকরণ করেছে নিবিড় বন্ধন

 

৪.

আন্তঃসংস্কৃতি সম্পর্কের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের একত্রে বসবাস। এই বিজ্ঞাপনটিতে আদিবাসী-বাঙালির যে-উপস্থাপন, তাতে আন্তঃসংস্কৃতি উপস্থাপনের একটি প্রচেষ্টাই দেখা যায়। বহুসংস্কৃতিবাদ সম্পর্কে আরও দু-একটি কথা বললে তা এ-রকম শোনাবে-এখানে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণে একটি একক সংস্কৃতি গঠিত হয় এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি সমানভাবে মূল্যায়িত হয়। এর মাধ্যমে নাগরিকরা ক্রমে ক্রমে বহুসংস্কৃতিবাদকে পরিহার করে অগ্রসর হয় মনোসংস্কৃতিবাদের দিকে। মনোসংস্কৃতিবাদকে ইসাভেল সালাদ বোল্ড তত্ত্বের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। সালাদ যেমন বিভিন্ন স্বাদ ও বৈশিষ্ট্যের খাদ্য উপাদানের সংমিশ্রণে তৈরি; এবং সেখানে সব খাদ্য উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটলেও প্রত্যেকটি উপাদানের স্বাদ-বৈশিষ্ট্য আলাদা-আলাদা থাকে। তেমনই আন্তঃসংস্কৃতির মধ্যেও একটি সার্বজনীন এবং কয়েকটি একক সংস্কৃতির গন্ধ পাওয়া যায়। এই বিজ্ঞাপনটির ক্ষেত্রে বিষয়টি বিবেচনা করলে দেখা যাবে, একই সঙ্গে বাঙালি ও আদিবাসীকে দেখানো হয়েছে। বাংলা ভাষা, আদিবাসী ভাষা, বাঙালি পোশাক, আদিবাসী পোশাক ও জীবন-যাপন প্রণালি, বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা অর্থাৎ যেসব উপাদানের সমন্বয়ে বাঙালি ও আদিবাসী সংস্কৃতি গঠিত সেগুলোর একটা মিশ্রণ দেখানো হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, রবি কিংবা ঘুরিয়ে বলা যায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের এই প্রচেষ্টা কেনো? এরা কি বৈষম্যহীন একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়; নাকি বৈষম্যহীন একটা আন্তঃব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে তুলতে চায়?

ঠিক উপরের বাক্যটিতে যে-অভিযোগটি করলাম তার ন্যূনতম যথার্থতা প্রমাণ করতে হলে অন্তত দুটি বিষয় পরিষ্কার করতে হবে। প্রথমত, নিবিড় বন্ধন আসলে একটা বুলি মাত্র। এবং দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞাপনটিতে দুটি সংস্কৃতির মধ্যে একটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে দ্বিতীয়টি সত্য হলে প্রথমটি আপনা-আপনিই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। তাই দ্বিতীয়টি একটু খোলা চোখে দেখার চেষ্টা করি। এ-ক্ষেত্রে আলোচনার প্রধান দৃষ্টি স্টুয়ার্ট হলের একটি বক্তব্যের দিকে থাকবে। যার মতে, গণমাধ্যম প্রাধান্যশীল গোষ্ঠী ও এলিট শ্রেণিদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে। এখন দেখা যাক, স্টুয়ার্ট হলের বক্তব্য এই বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে টিকে থাকে কি না-

. আদিবাসী-বাঙালির মধ্যকার আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন বা নিবিড় বন্ধনের নামে যে-দৃশ্যায়ন বিজ্ঞাপনটিতে উঠে এসেছে সেখানে কিছু বিষয়ের গুরুত্ব কিংবা নেতৃত্ব চোখে পড়ার মতো। যদিও আন্তঃসংস্কৃতি কিংবা নিবিড় বন্ধনে তা থাকার কথা ছিলো না। বিজ্ঞাপনের প্রধান নেতৃত্ব ছিলো মোবাইল ফোনের হাতে। কারণ, মোবাইল ফোন না থাকলে হয়তো বিয়ের পোশাকের ডিজাইন করাই হতো না। অবাক লাগে, আদিবাসী কন্যার বিয়ে; আদিবাসীদের বিয়ে। অথচ, পোশাকের ডিজাইন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে মোবাইল ফোন আর বাঙালি! এগুলোর মানে কী? মানে কী-এ-রকম যে, আদিবাসীদেরকে বাঙালি আর মোবাইল ফোনের লোভ দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে-দেখো, মোবাইল ফোন দিয়ে কতো কিছুর সমস্যা নিমিষেই সমাধান করা যায়! তা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া থেকে শুরু করে পোশাকের ডিজাইন করা পর্যন্ত। কিন্তু একটি খেয়াল করার বিষয় হলো, আজকাল যে-যে সমস্যায় পড়ে আমরা মোবাইল ফোনের শরণাপন্ন হচ্ছি তার কোনোটিই কি মোবাইল ফোনের বাইরে সমাধান করা সম্ভব নয়? সম্ভব। অধিকাংশই সম্ভব। প্রতিদিন নামাজের সঠিক সময়সূচি জানা, নতুন বন্ধু খুঁজে পাওয়া, কৃষি পণ্যের বাজারদর জানা, রিলেশন টিপস, রাশিফল জানা, বিনোদন জগতের খোঁজখবর, কোরআন-হাদিস শিক্ষা, ইংরেজি শিক্ষা, খেলার খবর জানা ইত্যাদির মতো এ-রকম অনেক বিষয় সম্পর্কে মোবাইল ফোনের বাইরে গিয়েও জানা সম্ভব। এই বিজ্ঞাপনের কথাই যদি ধরি-আদিবাসীরা পুরো বিয়ের আয়োজন করতে পারলো; আর সামান্য একটি পোশাকের ডিজাইন করতে পারলো না? পারতো, কিন্তু পারতে দেওয়া হলো না। মোবাইল কোম্পানিগুলো প্রতিনিয়ত আগ বাড়িয়ে আমাদের চোখের সামনে থেকে অনেক দায়িত্বভার ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। যে-দায়িত্ব পালন করা আমাদের জন্য মোটেও কষ্টসাধ্য কোনো ব্যাপার ছিলো না। এমনকি কোনো খরচও ছিলো না। এখন চৌদ্দ রকমের বাহানা দিয়ে চৌদ্দ রকম করে পয়সা আদায়ের ফন্দি আঁটছে টেলিকম অপারেটররা।

. আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, লাল কাপড় খোঁজার বিষয়টি। বিজ্ঞাপনে দেখি-বলা নেই, কওয়া নেই, বাঙালি ছেলেটি ঘরের মধ্যে এসে সোলকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে। দেখে মনে হয়, বাঙালি ছেলেটিই এই আদিবাসী এলাকার অধিবাসী; আর সোল এখানে অতিথি। যাই হোক, এরপর দুজন বেরিয়ে পড়ে লাল জামার সন্ধানে। যেখানে নেতৃত্ব দেয় বাঙালি। একটি দোকানে গিয়ে কাঙ্ক্ষিত জামা পাওয়া যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে-জামাটি বাছাই করা হয় তার সিদ্ধান্তও কিন্তু দেয় ওই বাঙালি ছেলেটিই।

. বিজ্ঞাপনটিতে বিয়ের প্রথম কাপড়টি দু-এক জনের পছন্দ হয়নি। এ-সময় পাশে বসা আরেকটি মেয়ে বলছে লাল হলে ভালো হতো। বিয়ের সময় কনে সাজানো হয়-সাধারণত লাল রঙের কাপড় পরিয়েই। সেই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে লাল রঙের প্রস্তাব অস্বাভাবিক কিছু নয়। তারপরও সন্দেহ হয়, এই প্রস্তাব কি কেবল স্বাভাবিকতা রক্ষার্থে, নাকি স্বাভাবিকতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের পছন্দের রঙকে আদিবাসীদের মধ্যে স্থান দিতে? কারণ, আমরা হয়তো জানি যে, রবির ব্র্যান্ডিং কালার লাল। এ-জন্যই দেখানো হয়েছে লাল হলে ভালো হতো-বিষয়টি এভাবেও ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। 

. বিজ্ঞাপনের শেষে দেখা যায়, বাঙালি ছেলেটি জামা ডিজাইন করার জন্য মোবাইলে কাউকে বলছে, কয়েকটি অপশন পাঠা। বোঝা যায়, তার কথামতো কেউ একজন অপশন পাঠায়ও। এরপর সেই অপশনগুলো নিয়ে বেশ কয়েকজন বসে সিদ্ধান্ত নেয়, কোন্ ডিজাইনটি বিয়ের পোশাকে করা হবে। কিন্তু এখানেও শেষ সিদ্ধান্তটি দেয় বাঙালি ছেলেটিই। যদিও বেশ কয়েকজন আদিবাসী ছেলে তখন সেখানে উপস্থিত ছিলো।

উপরে ক, খ, গ, ঘ দিয়ে যে-আলোচনা করলাম তার সারাংশ যদি কয়েকটি বাক্যে উল্লেখ করি তাহলে দেখা যাবে-

-জামা খোঁজার বুদ্ধি আসে বাঙালি ছেলেটির মাথা থেকে।

-দোকানে জামা পছন্দ করলো বাঙালি।

-সেই বাঙালি আবার জামার মডেলের সন্ধান করলো।

-আবার সে-ই সিদ্ধান্ত দিলো কোন্ ডিজাইনটি ভালো হবে।

এখন দেখুন, আন্তঃসংস্কৃতি কিংবা নিবিড় বন্ধন যাই বলুন না কেনো, কোনোটিই কিন্তু হলো না। ওপরে-ওপরে কেবল একটা ধোঁয়া তোলা।

কিন্তু কেনো এমন করলো কিংবা এমন করার ফলে কী এমন ক্ষতি হলো-আলোচনার এই মুহূর্তে এমন প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। তবে এ-দুটির উত্তর যাই হোক না কেনো, একই আলোচনায় সেই উত্তর সম্ভব। কারণ, দুটি প্রশ্নের উত্তর একই। তাই এখন সেই আলোচনার প্রচেষ্টা করা যাক-

মোবাইল ফোন বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় কেবল একটি প্রাযুক্তিক পণ্যই নয়। একই সঙ্গে তা একটি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। কারণ, আমাদের জীবনে এই বস্তুটির অনুপ্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গেই একটি জীবন ধারা, একটি সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে নতুন করে সংযোজিত হয়েছে। যে-সংস্কৃতির আলাদা কোনো নামকরণ নেই। নেই, কারণ এটি পৃথক কোনো সংস্কৃতি থেকে আমাদের মধ্যে বাসা বাঁধেনি। বরং এটি প্রতিনিয়ত ইনটেক অবস্থায় তৈরি হচ্ছে এবং আমাদের সংস্কৃতি পরিবর্তন করছে। উদাহরণ হিসেবে ডিজুস সংস্কৃতি কিংবা ডিজুস শব্দটির কথা বলা যেতে পারে। এটি সংস্কৃতি কিংবা শব্দ, কোনো আকৃতিতেই আমাদের সমাজে ছিলো না। কিন্তু আমাদের সমাজে ডিজুস এখন বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ, অর্থবহ একটি সংস্কৃতি। কারণ, ডিজুস প্রথম দিকে কেবল গ্রামীণফোনের একটি প্যাকেজ ছিলো। কিন্তু এখন আমরা কতো কিছুকেই তো ডিজুস বলি। ডিজুস ছেলে, ডিজুস মেয়ে, ডিজুস প্যান্ট, ডিজুস জুতা, এ-রকম অনেক কিছুই। আজকাল তো ডিজুস জেনারেশন শব্দটাও শোনা যায়।  অর্থাৎ, ডিজুস যে-কোনো বস্তু বা ভাবের ক্ষেত্রে এখন একটি মানদ- হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে-মানদ- অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের স্বাভাবিকত্বের বিপরীতে অবস্থান করে। স্বাভাবিক বলতে বোঝাতে চাইছি আমরা যাতে অভ্যস্ত ছিলাম, যাতে আমাদের অবাক লাগতো না কিংবা যা দেখে মুরব্বিরা নাক সিটকে বলতো না কী অবস্থা আজকালকার ছেলেপেলের! 

এই মোবাইল ফোনের আবির্ভাবে আজকাল ভাষা, নৈতিকতা, আত্মসম্মানবোধ ইত্যাদিতেও পরিবর্তন লক্ষণীয়। যেমন, আজকাল তো অপরিচিত অনেক মানুষই মোবাইল ফোনের কল্যাণে সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে।  ব্যক্তিগতভাবে সবাই এ-রকম অসংখ্য সম্পর্কের উদাহরণ দিতে পারবেন, যেখানে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে মোবাইল ফোন। কিন্তু এসব সম্পর্কের পরিণতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইতিবাচকতার দিকে যাচ্ছে না। কারণ, যোগাযোগ-কথাবার্তা চলছে একটা হাওয়ার ওপর। শুধু ফ্রিকোয়েন্সির ওপর গড়ে ওঠা এই সম্পর্কে নিজেকে ইচ্ছে মতো উপস্থাপন করার দারুণ একটি সুযোগ থাকে। যে হয়তো সপ্তাহে একদিন গোসল করে, সে হয়তো ফোনে হরহামেশা বলছে, একদিন গোসল না করে আমি থাকতে পারি না। আবার কেউ অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে এক্কেবারে খাঁটি প্রমিত ভাষায়। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে এ-ভাষা ওই মেয়েঘটিত ব্যাপার ছাড়া আর কোথাও সে ব্যবহার করে না। কিন্তু কিছুই করার নেই! কারণ, ভার্চুয়াল জগতে এটাই বড়ো সুবিধা, একই সঙ্গে এটাই বড়ো সমস্যাও। খুব বেশি আপত্তির সম্মুখীন হবো না, যদি বলি-মোবাইল নামক প্রতিনিধি দিয়ে মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করা যায় খুব সহজেই। আজকাল সামাজিক অবক্ষয় বলেন, অনৈতিক সম্পর্ক বলেন, প্রতারণা বলেন, লেবাস বলেন, ভণ্ডামি বলেন সবকিছুতেই মোবাইল ফোন সামনের কাতার থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছে। 

 

.

আলোচনা শেষ করবো। শেষ মুহূর্তে আদিবাসী সুন্দরী প্রতিযোগিতা নিয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই। কারণ, বিজ্ঞাপনটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আদিবাসী সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিষয়টি অনেকবারই ভাবনায় এসেছে। তাই বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পেঁচিয়ে একটু আলোচনার প্রয়াস। এই প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বটি আয়োজন করা হয়েছিলো কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। একই সঙ্গে সেখানে একটি মেলাও বসানো হয়েছিলো। মেলার উদ্দেশ্য ছিলো-আদিবাসীদের সংস্কৃতি সংরক্ষণের মাধ্যমে জাতিবৈচিত্র্য রক্ষা করা। আর সুন্দরী প্রতিযোগিতাকে বলা হচ্ছিলো-পিছিয়ে পড়া আদিবাসী নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের একটি মহতী উদ্যোগ। আয়োজক ছিলো মিডিয়া হাউস, কর্পোরেট কোম্পানি ও পর্যটন করপোরেশন। মেলার কথা না হয় বাদই দিলাম। মহতী উদ্যোগ নিয়েই কিছু কথা বলি। আদিবাসী নারীদের নাকি সামনে এগিয়ে নিতে হবে! নেবেন ভালো কথা। কিন্তু তার প্রথম শর্ত নাকি তাকে সুন্দরী হতে হবে! কিন্তু কেনো? যে-ট্র্যাকের দৌড় প্রতিযোগিতায় নারীকে সামনে রাখার প্রয়াস, সেই ট্র্যাকের বিজয়ের মাপকাঠি দৌড়ের সক্ষমতা নয়, বাহ্যিক সৌন্দর্য! অর্থাৎ, নারীর বুদ্ধি-বিবেচনা, শিক্ষা-দীক্ষা যাই থাকুক না কেনো, তাকে সুন্দরী হতে হবে। তবেই তাকে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু আমার যতোটুকু জানা, তাতে বর্তমানে পণ্য বাজারজাতকরণের প্রধান একটি শর্ত এটি। অর্থাৎ, পণ্যের মান যাই হোক, মোড়ক আকর্ষণীয় হওয়া চাই।

কিন্তু এই ভাবনা আজকের আলোচনায় কেনো আসলো, তা বলা দরকার। ভাবনায় এসেছিলো প্রথমত এ-কারণে যে, আজ উদ্দেশ্যর কথা কেউ মুখ ফুটে বলে না। পণ্যের তুলনায় মোড়ক যেমন আকর্ষণীয় হয়, উদ্দেশ্যর তুলনায় উক্তিও তেমনই আকর্ষণীয় হয়। আর দ্বিতীয়ত, এখন দেখা যাচ্ছে বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরা আদিবাসীদের দিকে ঝুঁকছে; কেউ আদিবাসী নারীদের এগিয়ে নেওয়ার বুলি আউড়িয়ে, কেউ নিবিড় বন্ধন-এর লোভ দেখিয়ে। অবশ্য পরিস্থিতি হয়তো সে-সময়ে চলে এসেছে, যে-সময়ের উদ্দেশ্যেই মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছিলেন নতুন নতুন বাজারের খোঁজে সারা পৃথিবী চষে বেড়াবে পুঁজির মালিক। সর্বত্র সে বাসা বাঁধবে, ঘরগেরস্থালি সাজাবে, সম্পর্ক পাতাবে। আবার এর কারণ হয়তো এই লেখার প্রথম বাক্যটি-সেই প্রথম থেকেই তো দিয়ে আসছে! প্রকৃতি মানুষকে আর কতো দেবে?

 

লেখক : তৈয়ব তরুণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

toyebur.rahman@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (২০০০ : ৬৪); ক্ষমতা প্রসঙ্গে দুই প্রেক্ষিত : গ্রামশি ও মিশেল ফুকো; ইতিহাসের উত্তরাধিকার; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

২. চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (২০০৮ : ২১); মহাশান্তির পরে বিশ্ব; প্রজা ও তন্ত্র; অনুষ্টুপ, ২ই নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা।

৩. প্রাগুক্ত; চট্টোপাধ্যায়, পার্থ (২০০৮ : ৩৭)।

 

সহায়ক গ্রন্থ

খান, কলিম (১৪০৬ বঙ্গাব্দ); সাংস্কৃতিক মহাবিস্ফোরণের অসনিসংকেত; দিশা থেকে বিদিশায়; হাওয়া৪৯ প্রকাশনী; কলকাতা।

জীবন আমাদের নয় (২০০১); বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি ও মানবাধিকার, পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, ডানা প্রিন্টার্স লিমিটেড, গ-১৬, মহাখালী বা/এ, ঢাকা-১২১২।

রহমান, হাবিবুর (২০০৪); বিভ্রান্তির বেড়াজালে পার্বত্য জনপদ; টর্চ পাবলিশার্স ২/১১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।

হক, ফাহমিদুল (২০১১); ‘‘আদিবাসী প্রিয়দর্শিনী ও সুন্দরী প্রতিযোগিতার রাজনৈতিক অর্থনীতি; অসম্মতি উৎপাদন; সংহতি প্রকাশন, ঢাকা।


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের চতুর্থ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন